Monday, June 7, 2010

সমুদ্র ও পাঁচজন আমি

সমুদ্র ও পাঁচজন আমি


(১)

রাতের ঝাউয়ের বন ঘেঁষে বালিয়াড়ির পাদদেশে ধিকধিক বনফায়ার, ওদের পাঁচটা মুখে আগুনের লাল লেগেছিল- এখন আর পাঁচটা মুখ নেই, বিয়ারের তোবড়ানো ক্যান হাতে গোড়ালি ভেজানো ঢেউয়ে আমি-

এ সমুদ্র এমত বেহায়া- তেমনই ওরাও পাঁচজন বন্‌ফায়ারের হাহা- পাঁচ কেন, ওরা চার, দুজোড়া কপোত-কপোতিনী, আমি তো ব্রাত্য ওই দলে, তবুও তো লোক চাই, দর্শক; নিজেদের প্রেমগুলো নিয়ে দর্শক না দেখলে ফ্যান্টাসি মেটেনা ওদের। ওরাও সমুদ্রের মত- ওই সমুদ্র, চাঁদের জলের রিফ্লেকশন ফসফস বলে ভুল হতে থাকে, হাওয়ায় পেট ফাঁপে ছেঁড়া ক্যারিব্যাগ যেন জেলিফিশ- এই সমুদ্র, চাঁদের আলোর পথ করে দেয় মানুষের কাছে, আমার কাছেও- লুনাটিক স্পৃহা সব সেই পথ ধরে হেঁটে গিয়ে অতলে তলিয়ে মরে যায়, মরে, তবু বেঁচে ওঠে তবু এই সমুদ্রের ধারে কাঠের আগুন থেকে হাওয়া বেয়ে ছিটকিয়ে যায় জ্বলন্ত জৈবযৌগ, ব্রেনের পাকগৃহ ঘিরে জৈব রিঅ্যাকশন হয়ে চলে, এসে পড়ে অসহ্য অতীত। এমনই সমুদ্র তার গাঢ় সব দুপুরের বেলাভূমি, স্নানের গহীন আর সেই সব কথা যেগুলো উহ্য রেখে সরে গিয়েছিলো আমার এইখান থেকে, আর কিছু ভাবিনা, আর কোনও স্বপ্ন দেখিনা, আর কোনও কান্না রাখিনি আগুনে- এই সমুদ্র তার ঢেউয়ে ঢেউয়ে, ফ্যানায়, ঝিনুকে শরীরে ছুঁইয়ে দেয় অভুক্ত ফুলের বাগান। ফলের পসরা ছাড়া এ জীবন ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, তাই, বৃষ্টি শুরুর আগে সমুদ্র আমাকে বাড়ি ফেরার বাসে তুলে দেয়।

(২)

এই সমুদ্র ওকে আমার জীবনে জুড়ে দিলো তাই আমি সেদিনের রোদ মনে করে রাত্রিনীল বালির মাঝে ক্যাম্পের আগুন জ্বালালাম। মাথার ওপর দিয়ে চুরি করে স্নান দ্যাখা ঝাউয়েদের দীর্ঘশ্বাস সব, আগুনের ফুল ওড়ে, ওর মুখে গিয়ে বসে উজ্জ্বল প্রজাপতি হয়ে, দারুণ আদর পেয়ে যায় আমাদের সেই কথা গুলো, বড়ো অনুচ্চারে, না শোনার মত করে আঙুলে আঙুল রেখে বলা। বৃষ্টি ভরা সাগর আমার, কেবল তোমারই নামে এঁকে যাবো প্রবল চুম্বন, প্রবল সমুদ্রস্নান, প্রবালের রঙ মনে পড়ে, মনে পড়ে আঙটিতে ঢুকে থাকা কিচ্‌কিচে বালি অহৈতুকী আধুনিক গানে এই সমুদ্রে এক দিন। একদিনে দুখানি অপর আরও কতো কাছাকাছি এসে যায়, তটবর্তী পাঁচিলের পথ ফাঁকা হয় তখনই নিজের মধ্যিখান থেকে সব আমি ডুবে মরে গিয়ে সেই একজন জেগে ওঠে, গভীর রাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে আমি তাকে ভেবে প্রণত হলাম।

###########################################################

ওই পেলিক্যান, শূন্য বিকেল জুড়ে

স্নানখেলা দেখে চলো,

তোমারও অতীত মনে পড়ে।

প্রতিটি বিকেল তার অতীতের

নিঃসঙ্গতা মেখে থাকে অবিরাম ঢেউয়ে।

পেলিক্যান, তুমি জানো নাকি

যখন সবাই শুয়ে পড়ে

এই সাগরের তীরে

অথবা, অন্য কোনওখানে

অন্য তটদেশে বা অন্য কোনও

নিস্তরঙ্গতা জুড়ে

পুরানো হাসির স্বর, ভুলে যাওয়া হাস্কি ভয়েস-

অবিরাম একা একা ঢেউদাগ ধরে

পথ হাঁটা- সবই থেকে যায়।

পেলিক্যান, তুমি দেখো, মনে করো

সানরাইজের ভীড়, গুরুভার সূর্যপ্রণাম

আঁচলে যে রঙ লুকিয়েছে

তুমি জানো পেলিক্যান, অন্ততঃ

তোমাকে তো জানতেই হবে

এই সাগরের মতো সেই প্রেমও শরীরিনী

পুরোপুরি রক্তমাংসময়।

(৩)

ঝিরঝিরে বৃষ্টির পথ, কিম্বা ছিটে আসা নুনজল, যার মেমরিতে এখনো কোডেড আছে চোখের গ্রন্থিঘ্রাণ। এই পথ ধরে একবার তোকে পেয়ে গেছি, তাই প্রতিটি পদক্ষেপে সর্ষের দানা ছুঁড়ে দিই- এই বৃষ্টিতে সব ফুল ফুটে যায়, এই বালুচরে যেদিকে তাকাস দেখবি হলুদে ফুলে ফুলে এমন স্পষ্ট করে তোর নাম লেখা- আমি ছাড়া কাউকেই ভাববিনা আর। যেমন আমিও। ওই যে দূরে দ্যাখ তারার মতই জলের প্রান্তে সেই আলোখানি জ্বলছে-নিভছে, ওখানেই নিয়ে যাবো তোকে, চারিদিকে জল আর রাত্রি, কাঠের আগুন- ঝলসানো তেলাপিয়া, পোড়াভাত জাহাজীর গুহা। ওইখানে আগুনের লালে তোর মুখে লেখা হয়ে গেলো মুক্তির দারুণ সত্তর। ওই মুখ দেখে যদি সত্যি পতাকা কোনও ভাবি- সেই নিশানকে ঘুম থেকে তুলে জাহাজের পথ ধরে ধরে সমুদ্রমথনে নিয়ে যাবো। মধুময় এমন রাত্তির, মধুঘেরা মুহূর্তখানি- এমনি দারুণ, এত বড়ো কিছু, শুধুই এরই তরে বাকি সবখানি, বিপ্লব, ঘরেফেরা, আর্তের চাকার কামনা- সব মুছে যায়- কেবল গলার কাছে পিরীত কাঁটাটি বিঁধে থাকে। প্রতি দুঃস্বপ্নেই ভাবি- যদি তুই ফেলে চলে যাস, সে কাঁটা ফিরিয়ে দিতে আমি, অনাগত এক সন্ধ্যায় সমুদ্রেরই কাছে নতজানু হবো।

##########################################################

ওহ্‌ গাংচিল-

হোটেলের নাম রেখে তটদেশে একঠাঁয়ে আছো

তুমিও তো ভূয়োদ্যাখা মাল

এই বেলাভূমি ঘিরে ওদের শরীর দেখে গ্যাছো।

ঝাউয়ের উলম্ব গুঁড়ি

ভেঙে দেয় গোটা ফ্রেমখানি

প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে তার

আমি-রা বন্দী হতে থাকে-

আর ঠিক সেমুহূর্ত থেকে

প্রত্যেকখানি আমি ছিটকে সরে যাচ্ছে

অতীতে বা না আসা ভবিষ্যে-

শুধু ওই দুজনের মাঝে

প্রেম জেগে আছে বলে

প্রেমময় অপার দয়ায়, দ্যাখো গাংচিল, দ্যাখো

আলাদা আলাদা খোপে, তবু,

একসাথে

এইসময়েই ওরা আছে-

(৪)

ভগবান আছেন বটেই, সমুদ্রতীরে এসে একথাই শুধু মনে পড়ে নাহলে এই ঢেউয়ের শীষে প্রথমদিনের গান জেগে থাকে, এমন মধুর নিয়তিতে এনট্রপি বেড়ে চলে চূড়ান্ত মৃত্যুর দিকে, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে যেই বিন্দু থেকে শুরু করে অনুরূপ কৌণিক অবস্থানে ফিরে আসে নিয়ত সময় বাদে অপরিবর্তনীয় ক্রিয়াপদ হয়ে সুন্দর জেগে ওঠে- ঝাউবন ছোঁয়া হাওয়া আমাদের তুচ্ছ কায়ায় সূর্যের স্মৃতি এনে দেয়- ভগবান আছেন বলেই। ভগবান আছেন বলেই, সৃষ্টির বংশগতি অপরিহার্য সেক্সকথা- যখন শরীরে শরীর এসে লাগে, প্রতি চলনেই তার নূতন শিহর জেগে ওঠে- ভগবান আছেন বলেই, পথ ও অজানা থাকে সময়ও পথের মতই, তারও অজানা একবাঁকে হাত ধরে ফেলেছি তোমার। এখন আমাদের মধ্যিখানে প্রতিদিনই সবখেলা সমুদ্রের রঙে- সেসমুদ্র বিভাজিত হয়, পথ কেটে স্মিত হাসেন গুরুদেব- যুগ্মমস্তকে যুক্ত করেন আশীর্বাদ তাঁর। আর সেই প্রত্যেক ভোরের সমুদ্রে, মঙ্গলঘট হয়ে দিনভানু উদিত হয়েন। সমুদ্ররাত্রি তাঁর বালুকার বিস্ময়খন্ড আমাদের কথা ভেবে রেখে যান। ভোর হবে বলে, এই রাত্রির বুকে আমি, আর সব বন্ধুর মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাই, তোমাকেও অদৃশ্য করি। সৃষ্টির শাশ্বতরূপে শুধু এই দৃশ্যমান তটভূমে, ঢেউয়ের উপমা নিয়ে আমি, তুমি, আমরা ম্যাজিক হয়ে যাই।

############################################################

পেলিক্যান মরে গ্যাছে কাল।

না, কোনও শিকারীর বন্দুক নয়, ভাইরাস নয়,

শুধু এক আচমকা ঢেউয়ের আঘাতে

উহার হৃদয় থেমে গ্যাছে।

পচে ওঠা পাখিশব আমাদের সমুদ্র

আজ রাতে ফিরিয়ে দিয়েছে

তাই, হোটেলের ফলক থেকে বেরিয়ে এসেছে গাংচিল

ঠোঁটে করে বালি নিয়ে যায়

তরঙ্গের অন্তিম দাগটিতে

পেলিক্যানকে সমাহিত করে সে-

(৫)

এইসব পাব্লিক শালা, কাজ নেই অকুন্ঠ-সময়খানি তাই অপরের ব্লুফিল্ম রচনায় নিবেদিতপ্রাণ- আর দেখো সারা বছরের ভারে কচ্ছপপিঠ বেঁকে গ্যালো, একটাই সপ্তাহান্ত সাগরসমীপে এসেছিনু। মাছভাজা, বীয়ার আর দুবেলার নুনমাখা চান- এরমাঝে এই মাল-এরা অন্যের প্রেমখানি ধরে, ধরে বা বানিয়ে নিয়ে নিজেদের চাহিদামতোই আমার গায়েতে ছুঁড়ে মারে- সমুদ্র, বস্‌ আমি তো ব্যাপক ছিলাম, তোমাতে আমাতে, বেশ বোঝাপড়া আর মস্তি বা লুকিয়ে পালানো- আমি তো বলিনা কিছু গোপনে লুকিয়ে যা যা চাই। সেসব সরিয়ে রেখে এই যে আরোপিত প্রণয়খানি, বড়ো দুঃসহ লাগে- বড়ো বেশি গুরুভার বেঁকে যাওয়া কচ্ছপ পিঠে- ওই শালা চুতিয়ারা বুঝবেনা, শুধু তুমি, আর, এমন বালের রাত নয়, দুপুরের সূর্য যেই জলে ভেজা বালিতে পিছলে ওদের অন্ধকার করে দেবে তখনই তো শুরু হবে আমাদের আদানপ্রদান। তোমারও কি কম চাপ সোনা- তুমিও যে আমারই মতন- জোয়ারের ক্ষণে তাই জেলেবস্তির কাছে চলে গিয়ে, হোকনা দুপুর, মাল আর মাছভাজা খাবো। সেই ভালো, এইসব ন্যাকাপনা বন্‌ফায়ার আর ততোধিক চোতা মারা পেরেমের মুখে স্নিকারের তলা ছুঁড়ে মারি। দুটোদিনই এবছরে বাঁচার সময়, ওইসব প্রেমট্রেম মুছে দাও গুরু- চোখ মুছে আমি জুতো খোলা খালি পায়ে তোমার শরীরে নেমে যাবো।