Friday, April 22, 2011

ভি-ডে কাব্যি

আমাদের সব প্রেম সিনেমায় দ্যাখা
রাত শেষে কন্যে সে চাঁদ ছুঁলো একা
সকালে আবির যেন রোদমাখা ধুলো
ঝিনুকের উচ্ছ্বাসে তাকে এসে ছুঁলো
দুপুরে দারুণ ঝড়- ঘোড়া টগবগে
ফুলের গুচ্ছ হাতে কন্যে-সহগে
কুমার ধরেন গান, ভিলেন তো মৃত
ল্যাপটপ খোকা ভাবে সেও খুঁজে নিত
অমন গল্প কোনও সেই চাঁদনিতে;
অমনি সারাটা পাড়া হলদেটে শীতে
থম মারে, শো ভেঙেছে হ্যালোজেন রাতে
চ্যাটলগে বিজ়ি প্রেম মশারি টানাতে-

Thursday, April 21, 2011

বিন্তি

চাঁদ ধরেছে সুড়ঙ্গ পথ
রাত নেমেছে বসরাই
টুকরো শনির নীলচে পরত
শুক্র সাঁঝেই বশ নাই
বসনজুড়ে আগুনদাহ
পশম বসায় চঞ্চু
হাঅরণ্য দীঘির বাহন
কাহ্ন স্বয়ং বনছুট
ছুট লাগালো আদরজীবন
উঠলো বেদম সূয্যি
চিনতি যদি, বিষ শিহরণ
বিন্তি, তোকেই খুঁজছি।

গ্রীষ্ম

জিরোতে বসেছে এই গরম দুপুর
অথচ ক্লান্তি নেই তার,
উত্তরে আকাশের তারাটিকে, আজও মনে করে,
শ্বদন্তে ছিঁড়ে ন্যায় মোরগের কবোষ্ণ টুঁটি
রক্তের স্বাদে কী আরাম?
অথবা রক্তের সাথে মৃত্যুর অনিবার্য মিল
খুঁজে পায় গরম দুপুর
ধোঁয়া ওঠা গরম দুপুর
বিকেলের কিছু আগে দিয়ে
মানুষের ঘরে ঢুকে যায়


খাট আলমারি আসবাব, রান্নার বাসন থেকে
হত্যার বীজাণু ছড়ায়, মৃত্যুতে ঢলে পড়ে
সঙ্গম, রাত্রির কাল
উত্তরে তারা থেকে ভেসে আসে আলো, মিছিমিছি

সরস্বতী পুজো, মফস্বল

ফুলের স্তবক রাখা পথজুড়ে
পথ ঘুরে নির্জন, ঘুরপথ মাইকমুখর
সেই পথে স্তবগান রিক্সায় ভেসে
স্তবে ভাসে প্রথম আমেন
স্তাবক সে সাইকেলে, দেবী তারে সুপথে রাখেন

সুমতিরা স্কুলে যায়
মহাখিচুড়ির ভোজ, চাটনিতে আচারের তার
ধারের বেপাড়া জাগে প্রদর্শনীর রাত,
ভাসানে জাগেন অবতার
স্তাবক এখনও দ্যাখে, হে দেবি সারদে,
হাওয়া ভেসে আসে ওড়নার
ডোনোভান গেয়ে যান ইয়েলো ইজ ় দ্যা কালার-

ঐশী

মায়াকে নির্মাণ করি খড় দিয়ে
তার ওপরে লেপে দিই মাটি, তুলির আদর টানে
রঙে আঁকি চোখ, ঠোঁট, থুতনির ঈষৎ বামে তিল
মাটির ভিতর জুড়ে রক্তের নালিকা সকল, হৃদয়-

ছায়া বসিয়ে দিই পাশের ঘরেই
লেবুপাতা ছুঁয়ে দ্যায় ঝিরিঝিরি শীতল আদর
বিকেলের রঙ লাগে, ঝিম ধরে, পাখি নেমে আসে
খড়ের বাসায় তাকে যত্নে বসিয়ে দিই, বিড়ালের থাবা থেকে দূরে-

কামনা নির্মাণ করি শব্দ দিয়ে
থম মেরে বসে থাকে ঝিঁঝিঁর গোলাপি রাত্তির
দূর থেকে হর্নের মতো ভেসে আসে আলোর আওয়াজ ।

তারপর, পার্কিং লটে উহাদের দ্যাখা হয়ে যায়-

নেড়াপোড়া

আগুনে মাংস পোড়ে
ঈশ্বর-আদেশ সেইরূপ
বনস্থালী পুড়ে খাক্‌, ছাইয়ের গাদার নিচে
স্তূপ-
-আকারে ভক্ষ্য থাকে
মিঠে আলু, বেগুন, আতপে সেদ্ধ হওয়া চাল
বিনিময়ে সিদ্ধি মিলে, বিনিময় মিলের গোপাল

বিধর্মীর বাড়ি পোড়ে
পাদ্রী পোড়ে শিশুটির সাথে
নীরব শান্ত গ্রাম ভেট আসে রাজার সেবা-তে
আগুনে ভিখিরি পোড়ে
আগুন জ্বালান ভগবান
পূর্ণিমা আকাশে ভেসে ‌যাওয়া চাঁদের বাগান

বাগানে কুসুমদোলা, রঙ থেকে রঙে হিল্লোল
ঈশ্বর উবাচ, ফাল্গুনি-
দ্যাখো, কাল আমাদের দোল

Bipolar

অতি আরবিট সব সেক্স প্র্যাক্টিস,
মেট্রোর কামরার ফাঁকে
উইলিদুর্গপাশে বৃহ্ৎ ব্যারাকে
হাতিশুঁড় প্রেম যা যা জমা রাখতিস-
...
অতি গোপনীয় সব ভোরের ফেটিশ
ট্রাম থেকে ধুলোঘোরা মোড়ে
সফেদ সৌধ থেকে রোদের পালক মেখে ওড়ে
পরী, তার করুণা পেতিস
...

অতি মলমীয় সেই ক্ষতে পুলটিস
গোপন রাখার খেলা, ঘাস ও ময়দান
ব্লেডের করুণা আর সিলিং-এর দড়ি টানটান
বনবীথি চুপ- ঝুলছিস-

গাজন

ফেটে ওঠা মাটি এই চৈত্রের বুকে রক্ত চেয়েছে মাগো এরকমই সন্তাপ আঁধি ফিরে ফিরে আসে নিযুত বছরে তার তারাচিহ্ন ছাপে ধরে রাখি আঙুলে ছুঁচের ডগা জিহ্বাগ্রে বর্শা আর বিভিন্ন অস্তরে ছিঁড়ে ফেলি চামড়ার গ্লানি প্রগাঢ় উপোস অন্তে সোঁদাসোঁদা গেটের গভীরে গাভীর বিষাদচোখে দেখি বরষা আঁধারঘন কালো মেঘ মেশে ধানক্ষেতে গাভীটিও ঘরে ফেরে ফেনিল এই উৎসব শেষে মহামারী রোগ মৃত্যু আদি ক্রমশঃ চৈত্রে এসে পড়ে অনেক বসন্তের এই পথ অনেক কূজন আর অনিবার্য সব দংশন বুক থেকে মাংসের মত খুবলেখুবলে খায় চোখ, স্তন্য, প্রত্যঙ্গসকল- উপবাস শেষে তাই কাঠের মাচায় উঠে আসি বৎসরান্তে কণ্টকে ঝাঁপ দিতে বিষ। তারপরই প্রখর নূতন-

Wednesday, March 2, 2011

রাতের সাইকেলে চৌরাস্তার দিকে আমি

ওসব পেছনে ফেলে আসি
বিদ্যুতে বিদ্যুতে তবু তোর চিঠি খুঁজে ফিরি আজও
এমন-ই এ রাত নামে
গাঢ় হয় তৃষ্ণা আমার
ঘুম নামে জ্যোৎস্নার পথে
শুধু মন্ত্রের মতো, শুধু শব্দের মতো এগিয়েছি
রাত্রির সাইকেলে চৌরাস্তার দিকে আমি
সবকটা কষ্টই কেঁদে ফ্যালে তখনই এমন
প্যাডেল বিফল ঘুরে যায়।
এমন রাতে আমি শুধু একা, একান্ত আওয়াজ
যদি চিৎকার ক'রে কাঁদি,
ঘুম ভেঙে কেউ শুনবেনা
যদি হাহাকার করি
যদি হাহাকার করি তোর নাম ধ'রে
মেঘে মেঘে ঘষা খেয়ে উবে যাবে
চাঁদ-ঘ্যাঁষা কান্না আমার।

আমি ঘটালাম এক অভিজ্ঞতা

আমি ঘটালাম এক অভিজ্ঞতা
তখন দুপুরের উচ্চারণ
ড্রইং শিটের ভিড়ে জমে ওঠে শীতকাল
প্রাপ্তবয়স্ক শহরেতে
গঙ্গার পাড় ধরে ভেসে যায় পিকনিক
আর, আমি বসন্তে এসে পড়ি,
কলেজেও উৎসব পড়ে
কাঁচঘুরে ক্লাসঘরে ভেসে আসে ব্যান্ডের গান
একলা মাঠের বুকে এমনই হলুদ রোদ্দুর
আর ঘুরপথ ক্যান্টিন খোলা হাওয়ায় মাতামাতি সব
আমের বোল আসে ঝিরঝির বিকেলপাড়ায়
সেইসব মুকুলের ফুটে ওঠা রাস্তা বিঁধিয়ে
এরকমই ঋতুরোগে মিছিলে সামিল হয়ে গেছি।

তারপর অভিজ্ঞতা, বেঁচে থাকে যেমন মানুষ
বেঁচে ওঠা যেমন হয় রিকেটে খোঁড়ানো পা নিয়ে,
এখনও লড়াই চলে
এখনও লুকোনো কুঠুরিতে
ফিকে হওয়া তুলোট কাগজের ভাঁজে আঁকড়িয়ে ধরা থাকে
গুঁড়োগুঁড়ো সবুজ পরাগ
মহীরুহ হয়ে ওঠা গাছ
ছবির দেশের মেঘমালা আর ক্যামেরা হারানো ম্যাসাঞ্জোর
কিম্বা হীরাকুঁদে রুকস্যাক

তারপর জ্বলে ওঠে পিয়ানোটা
এখনই আসর শুরু হবে,
অথচ অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে বলে দিয়ে গ্যাছে,
এরপর ঠিক কী কী হবে
কীরকম হতে পারে,
কোথায় কতটা আনচান- তলপেটে ব্লিজার্ড কখন;
আর সেই মিছিলের রাজপথে, মহাসড়কেতে
যুদ্ধের সব ক্লাসরুমে
বেহালা বাজিয়ে যায় নির্বাসন
মেট্রোর একলা পাতালে, শিউলিফুলের মত
ঝরে পড়ে অভিজ্ঞতা সব।

Tuesday, March 1, 2011

পুরাতনী

সবই তো পুরোনো হয়ে আসে
ঝিকমিকে রোদ্দুর, বিকেলের ফিকে হওয়া আলো
বিপন্ন চোখে চোখে মায়ারা যে স্বপ্ন বসালো
কী সহজে তারাও ফ্যাকাশে

মিছিলের উত্তুঙ্গ দাবি
শহরের রাজপথে জনরোষ, লড়াকু নিশান
ভোর আসবেই ভেবে ভিতরের ঘুমভাঙা গান
সে স্লোগানও অস্তস্বভাবী

খুঁজে পাওয়া সূর্যের দেশ
রাতের দেওয়ালে ছিল সেই স্বপ্নের ছবি আঁকা
বিষাদের বুক নিয়ে গঙ্গার ঘাটে একা একা
আজ তার ধ্বংসাবশেষ

এসবই ফুরিয়ে গ্যাছে শোনো
হলুদ ছবিরা আর অ্যালবাম, কবিতার বই
রাত নেমে এলে আমি তোর নাম ধরে চ্যাঁচাবোই
সেই নামও অতীব পুরোনো

ফেরা

এ শহর সবকিছু জানে
কোনও এক মানবীর তরে হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে
রক্তের অবিরাম স্রোত
নিয়তি যেমন, বয়ে যায়
একলা রাতের বাসস্ট্যান্ড - ভীড় বাস
লাস্ট ট্রেনে বাড়ি ফেরা, মেট্রোর মত তীব্রতা
আর পথের বাঁকের মোড়ে
অপেক্ষা, শহরের মতো
বাইপাসে একলা হেঁটেছি, শীত শেষ হলে দেখো
দুপাশের লালফুল-রাধাচূড়া-ধুলোধুলো বসন্ত মাখে
আর সেই রক্তের স্রোত
নিয়তি যেমন, বয়ে যায় -
বাস কমে, ফুটপাথে উঠে আসে মানুষের বাস
রাস্তা একলা হয়ে পড়ে।

নতুন পাতার সেই ঘ্রাণ- ছায়াপথে
কুয়াশা সরালে সব প্রকাশ হয়ে যাবে
তবুও এখন,
এখন দুহাত পেতে ভিক্ষে করছি উষ্ণতা,
সম্বল হারিয়েছি তোর সাহচর্যে যা যা ছিলোঃ
গরমভাপের মতো, ঘোরাপথে নিঃশ্বাসবায়ু,

এই শীতকালে আমি একলা থাকার চেয়েও
একা--

এখনও কলকাতা

এখনও কলকাতা- তুই জেগে
ঘুমে ও স্বপ্নের সংবেগে
এখনও পথে বাসে ভিড় জমাট
কক্ষপথ থেকে বাড়ায় হাত
দিনের শেষে এই ঘুমের রেশ
ক্লান্ত মুখে তোকে লাগছে বেশ
এখনও এই পথে রাত কি দিন
ভাবনা হাঁটে সেই সঙ্গীহীন
নিঝুম বাসস্ট্যান্ড অপেক্ষায়
স্বপ্ন ছুঁতে আমি নিঃসহায়।

এদিকে বৃষ্টির স্তম্ভেরা
আরও দূরে সরে ঘর-ফেরা
কুয়াশা, সাদা হওয়া সবুজ মাঠ
জানলা ভিজে ওঠে মেঘলা ছাঁট
ও মাঠ পেরিয়ে আরও দূরে
পথে ও ঘুরপথে গোল ঘুরে
কোথায় রাখা বাড়ি, কলকাতা?
ঘরের অভিমুখে পথ হাঁটা
সে পথ হারিয়েছে রাত এলে
একলা রাস্তার সাইকেলে।

শব্দ রাখা মানা, গভীর রাত
অন্যপথ জুড়ে চাঁদের হাট
হাটের মাঝে জ্বলে - অ্যামেরিকা
ডিগ্রি-ডলারের স্বস্তিকা
রোদের চড়া সুরে উচ্চারণ
রক্তে হৃদয়ের প্রস্রবণ
ভেসেছে, কলকাতা কোথায় তুই
আমিও একা একা রাত্রি ছুঁই
আরও গাঢ় রাতে হুইসেলে
ঘরের ফেরার এক ট্রেন মেলে
সে ট্রেন ছেড়ে আসে চাঁদের হাট
কলকাতার বুকে বৃষ্টিপাত
ভিজবো বলে আমি কান্না হই
একলা হারাবার ভরসা কই?
ভরসা, হারিয়েছি - আমার ঘর
কতদূরে তুই, তোর শহর।

এস এস সি

এখানে আমার পরীক্ষার সিট পড়েছিল
শহর থেকে যে সরণী সরোবর আভিমুখে যায়-
ভিড় বাজার আর পসরার ফুটপাথ ঠেলে
গলির গোপনে গলি জেগে থাকে, সেই পথ ধ'রে
-- একটা স্কুলবাড়ি,
তার সামনে মাঠ,
অন্ত্যেবাসীর করতল ছোঁয়া
এমনই বিবর্ণ কিছু দেওয়াল আর দেওয়ালের লেখা
ছোট বেঞ্চ, ক্যাঁচক্যাঁচে শব্দের পাখা,
এসবই সইয়ে নেওয়া।

এখানে আমার পরীক্ষার সিট পড়েছে,
আর সামনের উঠোনে, ঘুণধরা দর্জার চৌকাঠে
জুতো ঘষতে ঘষতে আমি, অপেক্ষা করছি তোমার

নির্বাসনে

সত্যিরা বড়ো বেশি বাস্তব
একটা সত্যি এসে আর সব দিন মুছে দ্যায়
আলোর ঝল্ক এসে পড়ে
সামনের পথ দেখি শুধু আরও দূরে সরে গ্যাছে
আর শুধু দূরে দূরে রাখা থাকে
গাছেদের ছায়া, স্বপ্নমায়ার মতো সেই কোনও মৃদুল বাতাস
পূবালি গন্ধ বয়ে আনে

তোর ছবি ফিকে হয়ে আসে
শুধু স্বপ্নের ঘোরে তীব্র ভীষণ বেদনায়
ঘুমের পরিধি জুড়ে নীল রঙ আরও গাঢ় হয়।

Saturday, January 29, 2011

মহাভারতের কথা

ভারতকে খুঁজে পাই ছ'বছরের কিছু বেশি আগে, যখন সদ্য অ্যামেরিকা এসেছি। অক্সিজেনের ঘাটতি না হলে সেটা যে ছিল টের পাওয়া যায় না, আমার ভারতে পাওয়াও কিছুটা ওরকম। ভৌগোলিক ভারতবর্ষে থাকতে মনেপ্রাণে উপলিব্ধি করতাম, কলকাতাটাই আমার দেশ। বাকি এলাকাগুলো পাসপোর্ট-ভিসাহীন বিদেশ, আসলে দেশ আর ঘরের পার্থক্য বুঝিনি। যাই হোক, সেই পার্থক্য নিরূপণের জন্য এ লেখা নয়, তবে দেশ মানে কেবল ঘুম থেকে দাঁত মাজতে মাজতে পাড়া ঘোরার আরামটুকুই নয়, সেটাই হয়তো বাকি লেখায় বোঝার চেষ্টা করবো। যাই হোক, অ্যামেরিকায় এসে যেটা খেয়াল করতে শুরু করি, যে, এদেশের বৈভব ও বিস্তারে আমার কোনও অধিকার নেই। অধিকার নেই আমার কলেজ যাওয়ার রাস্তার গা ছমছমে অঞ্চলটায় কেন পুলিশ থাকেনা জিগেশ করার কিম্বা সিম্পলি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিন হক করার। ভারতে এসব বললেও হাইলি কোনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পাত্তা দেবেনা, কিন্তু বলবার/করবার অধিকারটুকু আছে- এই অধিকার থাকা আর না থাকার বোধ একটাভাবে নিজের জীবনচর্যাটায় পার্থক্য এনে দিচ্ছিল- দেখছিলাম, সত্যিই বিদেশে আছি। কিন্তু এ গল্প দেশ ও বিদেশের, মহাভারতের নয়; তবে হয়তো এইখান থেকেই শুরু। কোনওভাবেই মানিয়ে নিতে পারিনি অ্যামেরিকান সমাজে। মানিয়ে না নিতে পারা অবশ্যই অক্ষমতা, আর, আর-পাঁচজন দেশির মতন আমিও অ্যাপার্টমেন্ট ডিপার্টমেন্ট ও দেশি পার্টিতে বন্দি হয়ে বছর কাটাতে লাগলাম। আর, এই জীবনটা খুব পীড়া দিচ্ছিল। ক্রমশঃ কোর্সওয়ার্ক ক্লাসরুম থেকে দূরে সরে এলাম যখন এদেশি বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও কমলো, ফলে বিচ্ছিন্নতা বাড়লো- পুরো সমাজটার মধ্যে একদম বাইরেওর একজন অবজ়ার্ভার হয়ে থাকলাম। এবং এই পীড়াদায়ক বিচ্ছিন্নতা যেহেতু সবচেয়ে বাজে রাখে নিজেকে বারবার একটা খোঁজার জায়গা এলো, কোথায় আটকাচ্ছে বোঝার জায়গা এলো।

এইখান থেকে আমার ভারত দ্যাখার শুরু, অ্যামেরিকার বিশেষতঃ লুইসিয়ানার সমাজের প্রতিতুলনায়। আমি দেখছি অভিযাত্রী সমাজের এক উত্তরাধিকার, বন্দুকের বাঁটের থেকে রেড ইন্ডিয়ান রক্ত মুছতে যাঁরা রোববার রোববার চার্চ যেতে বাধ্য, আবার রক্তের প্রবাহে মিশে আছে গান ল, শিকার- এমন কী খোলা মাঠে মাং পোড়ানোর উদ্দাম বার্বিকিউ; আমি দেখতে পাচ্ছি শুক্রবার রাতের কে যে কার প্রেমিকা কে যানে পার্টি আর গ্রেট অ্যামেরিকান ড্রিম ভেঙে ভেঙে ফুটে ওঠা ক্রীতদাস প্রথার অবশেষ। আর, দুদিকেই তার আগের ইতিহাসটা ভুলে যাওয়া। অ্যামেরিকা নিয়ে বাজে বাজে কথাগুলো বললাম কারণ আমার বাজে থাকার জায়গা থেকে তুলনাটা আসছে, ভাল কথা চাইলে অজস্র বলা যাবে সেটাও বলে রাখলাম। যাই হোক, উল্টোদিকে আমরা ইতিহাসের অধীন, কম-বেশি মিলিয়ে কী করবো, কী করতে চাই আর কী কী করে থাকি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ইতিহাস দিয়ে, শুধু খাদ্যাভ্যাস দেখলে চোখে পড়ে, দেশের আদ্ধেকলোক নিরামিশাষী কেবলমাত্র তার পিতৃ-মাতৃবংশে কেউ আমিষ ভক্ষণ করেন নি বলে। আর এরকমটাই ধর্ম। ধর্ম অর্থে 'হিন্দু' নামের সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া শব্দটা বাদ দিয়ে বায়ুর ধর্ম, জলের ধর্ম, জীবনের ধর্ম - এই প্রসঙ্গে আসা ধর্মের কথা ভাবি, ছোটবেলা থেকে শুনেছি যা ধারণ করে রাখে, আর তা কখনওই রিলিজিয়ন হতে পারেনা। দেশের লোক ব্রহ্মবাদী থেকে তান্ত্রিক হয়েছে, প্রকৃতিপূজক থেকে বৌদ্ধ হয়েছে, বৌদ্ধ থেকে বৈষ্ণব-মুসলমান হয়েছে। রিলিজিয়ন পাল্টেছে কিন্তু ধরে রাখার ঐতিহ্য পালটায় নি। সেখানে ভারত খুব ব্যাপ্ত হয়ে যায়, কলকাতা থেকে ট্রেনে চড়ে দক্ষিণভারত গেলে মেদিনিপুরী ডায়ালেক্ট ক্রমশঃ উড়িয়া, উড়িয়া ক্রমশঃ দ্রুতছন্দে উচ্চারিত হতে হতে তেলেগু হয়ে যায়; কিন্তু মানুষ কোনও এক জায়গায় এক থাকে। এই এক থাকাটাই ভারতবর্ষ- একটা অসম্ভব দেশঃ জাতীয়তা বা সংস্কৃতি বা অর্থনীতিতে দেখলে রাজনৈতিক ভাবে এদ্দিন দেশটার এক থাকার কোনও কারণই ছিল না। অথচ এক আছে, অথচ এক আছে কারণ কোনও এক অন্তর্নিহিত ঐতিহ্য তাকে 'কী করিতে হইবে' বলে দিচ্ছে- বংশ পরম্পরায় শূদ্র বিন্দুমাত্র রক্তপাত না ঘটিয়ে সেবা করে যাচ্ছে তিন উচ্চবর্ণের। রবীন্দ্রনাথ বলছেন 'য়ুরোপ খুব করে হতে চাইছে, আর আমরা চাইছি ভবের বন্ধন কাটাতে, না হয়ে যেতে'। আমরা দীন হতে চাইছি, বৈভবকে ঘৃণা করছি, এমনকী চারপাশের লোকজন আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকালে লজ্জায় মাথা নিচু করছি। এই না হওয়াটা আমার এখানে এসে বোধে এল। পার্টিতে-উৎসবে চারপাশের লোকজনের থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে রাখা কিম্বা পুরোপুরি ভিড়ের মধ্যে লক্ষ্যের বাইরে থাকা একজন হওয়াটাই আমাদের আরাম-অঞ্চল। নিজের আনন্দ নিয়ে উচ্ছ্বাস আমাদের কাছে অতি-উচ্ছ্বলতা। নিজেকে ঢেকে রাখা হয়তো সবসময় সাপ্রেশনও নয়, ভেতর থেকে আসা কিছু। আমার কাছে ভারত বিস্তার করেছে এই না হয়ে ওঠার জায়গাটাতেই। ভূমণ্ডল এবং তদোর্ধএর অধিকারী সবিতার কাছে আমরা জ্ঞানসাধন প্রার্থনা করছি, জেনে বা না জেনে গায়ত্রী মন্ত্রে। আর ভারতের টিকে থাকা এই জ্ঞানসাধনে, সেখানে অগ্রাহ্য করা হয় মুহূর্তের উন্মাদনা, মানুষের বানিয়ে তোলা রূপরসগন্ধের কামনা, আনন্দের পশ্চিমি সংজ্ঞা। এই জন্যই তিনহাজার বছরের ইতিহাসে ভারত কখনো বিদেশে সৈন্য পাঠাতে পারেনা (শ্রীলঙল্কা কলোনাইজ় করতে অশোককে সৈন্যর বদলে শ্রমণ পাঠাতে হয়, সে অধিকার জ্ঞান-এর অধিকার বলেই) , নিজের যাবতীয় দুঃখ কষ্ট স্বত্ত্বেও দলিত পারেনা ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে। কারণ, এর সবগুলোতে নিজেকে বড়ো বেশি পাত্তা দেওয়া হয়ে যায়। কমিউনিটি হিসেবে এই নিজেকে নিজের ভিতর লুকিয়ে ফেলার মধ্যে বেশ বড়ো ধরণের একটা দেশ গড়ে ওঠে, যাঁরা ধর্মাচরণ করে যান জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে- ঘুম থেকে উঠে সূর্যপ্রণাম যেমন ধর্ম, সহমানুষের গায়ে পা লেগে গেলে নমস্কার করাও তেমনই ধর্ম সেখানে। আর, আরও বড়ো ধর্ম পার্থিব সুখভোগকে অগ্রাহ্য করার, কারণ তাঁদের মনে হয় ইন্দ্রিয়দমনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবী বা তারও বাইরের জিনিসগুলিকে বুঝে উঠতে পারার ম্যাজিক।



যাই হোক, এটা একটা উপলব্ধি, ভারত নামের অসম্ভব দেশটাকে ভারত থেকে বাইরে থাকার যন্ত্রণা নিয়ে একভাবে বোঝা, একভাবে ফ্যান্টাসাইজ় করাও- তবে এদেশ মহান নয়- এখানে খাপ পঞ্চায়েত থেকে বিনায়ক সেনের জেল সবই হয়। আর ভারত মানে শুধু আসমুদ্রহিমাচল ভূখণ্ডটিও নয়- খোদ অ্যামেরিকাতেও অনেক টুকরো টুকরো ভারত দেখেছি- দুহাজার বছরে দেশের ব্যাপ্তি খুব কম হয়না