Tuesday, December 7, 2010

দু-প্যান্ডেলের মাঝখানটায়

দুটো পুজোর মাঝখানে এক অনিবার্য নির্জনতা থাকে। রাত্তিরে যেখানে এক প্যান্ডেলের আলো শেষ হয় আর, আরেকটার আলোর রেশ বেশ খানিকটা দূর থেকে দ্যাখা যাচ্ছে, পাড়ার সেই অংশটায় স্বাভাবিকভাবেই অন্ধকার জমাট বেঁধে ওঠে, সেখানকার দোকানগুলোয় অষ্টমীর সন্ধ্যেতেও একটাকা চারআনায় চার্মিনার পাওয়া যায়, টিমটিম করে হলদে বাল্ব জ্বলে, বুড়ো দোকানদারের সঙ্গে ভাবলেশহীনমুখে দু চারজন রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যাজার আড্ডা মারে। রাস্তার পাশে কোনও একটা বাড়ি থেকে চলতি মেগা সিরিয়ালের গান ভেসে আসে। এমনকী খুব নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ঐ বাড়ির ক্লাস সেভেনের কন্যাটি সেই সন্ধ্যেতেও গঙ্গানদীর উৎপত্তি বা ছোটনাগপুরে অ্যালুমিনিয়াম খনির নাম মুখস্ত করছে। আর এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ার প্যান্ডেলে যাওয়ার মুখে পাব্লিক খুব দ্রুতপদে রাস্তার এই অংশটা পেরিয়ে যাচ্ছে। অথবা একটু আড়াল খুঁজে নিয়ে দেখবো একজন দুজন দেশলাই-এর পিছন দিয়ে সিগারেটের তামাক খুঁচিয়ে গাঁজার পাতা ভরছে, অথবা কোথাও চাপাস্বরে ঝগড়া চলছেঃ পুজোর মার্কেটে গ্রুপের অন্য কেউ যথাযোগ্য সম্মান না দেওয়ায় বছরের বাকি দিনগুলো কীভাবে তাকে দেখে নেওয়া হবে সেই সংক্রান্ত আষ্ফালন। আবার ওরকম-ই একটা রাস্তায় সন্তু মিন্তি ও মিন্তির বোনের পিছন পিছন হাঁটছে; কিম্বা মিন্তির বোন নেই, সন্তু খুব ভয়দুরুদুরু বক্ষে অবশেষে বলেই ফেলছে- মিন্তি, তোর সঙ্গে একটা দরকারি কথা ছিলো। আধঘন্টা পরেই বাপী আর টুবলূ এই রাস্তা দিয়ে বলতে বলতে ফিরবে, সন্তুতো লুটে গ্যালো রে, মিন্তির নতুন শিকার জুটলো।
আবার, মফস্বল ছেড়ে শহর কলকাতায় ঢুকলে এইসব জায়গায় কোনও বেচারী হোমগার্ড-কে ডিউটি দিতে দেখবেন, যে চ্যাংড়াটা এক্ষুণি জিগেশ করে গ্যালো ‘মামা, জগুবাজারের অটো কোনখান থেকে পাবো?’ তার উদ্দেশে দাঁতে দাঁত চেপে বলছে – ‘আমি তোর মায়ের ভাই হই এই গ্যারান্টী কোদ্দিয়ে পেলি শুয়ারকা’। একথা সবাই জানে ওই ভদ্রলোকের কাছে খৈনি আছে এবং অটো কোন রাস্তায় যায়, তা তিনি জানেন না। তবে অনুরূপা এবং তার গার্লস কলেজ দলবল ওনাকে দেখে বড়ো ভরসা পেয়েছে, এসব রাস্তায় পুজোর দিন হলেও কেমন গা ছমছম করে কিনা, স্পেশালি কয়েকটা হোস্টেল কাটিং ছেলে পদ্মপুকুরের লাইন থেকেই যে ভাবে অ্যাটেম্পট নিচ্ছিলো। আপাতত বোধিস্বত্ত্ব এইখান দিয়ে হনহনিয়ে, রাদার বলা ভালো দৌড়েই যাচ্ছে, ম্যাডক্সে লোকজন গোল হয়ে বসবে, অলরেডি একঘন্টা লেট, সুদীপ্তা কার সঙ্গে গপ্পো জুড়ে দিলো কে জানে, আর উলটো দিল থেকে তুমুল ঝগড়া করতে করতে সৌমিতা-রাণা হেঁটে আসছে; সৌমিতা হয় এই শেষ কথা বললাম বলে তুমুল চেঁচাচ্ছে (হোমগার্ড সাহেব বেশ আমোদ পাচ্ছেন এতে) অথবা জাস্ট কোনও কথাই বলছে না, রাণা-কে তো বলেই দিয়েছে, আমি আলাদা আর তুই আলাদা ঘুরছি, এর পর আর কথা বলারও কিছু নেই। আর প্রথম নাইট আউট করবে বলে অনির্বাণরা পথে বেড়িয়েছে, সুযোগের সদ্ব্যাবহার করে সন্দীপন অলরেডি দুপেগ মেরে দিয়েছে, বোতলটা দিব্যেন্দুর ব্যাগে, এখন কিছুতেই বের করা যাবেনা, ভোররাতের দিকে একটা পার্কমতন জায়গা দেখে উল্লাস করতে হবে কিনা! কিছু মামণি, যাদের দেখে এই পাড়ার-ই মনে হ’লো ঝলমলে শাড়ী পরে হেঁটে যাচ্ছে, বিভাস বুঝে উঠতে পারলোনা দু লাইন গান গাওয়া রিস্কি হয়ে যাবে কিনা! এসবের মধ্যে দেখবেন একটা প্রাইভেট কার বিশ্রী হর্ণ বাজিয়ে বেমক্কা জোরে বেড়িয়ে গ্যালোঃ কাকু কাকিমা ভাই-বোনদের নিয়ে সারারাত ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছেন। জ্যাম এড়ানোর জন্যে ড্রাইভার এই রাস্তায় ঢুকলো এবং ওয়ান ওয়ে দেখে আবার বেড়িয়ে যাচ্ছে- কাকিমা চেঁচিয়ে গাড়ি দাঁড় করালেন, মিনারেল ওয়াটার কিনবেন। আর কিছু আরবিট মাল আছে, যাদের পুজোর সময় ঘোরার লোকজন নেই, এদিকে বাড়ি বসে থাকা বা ভীড়ের প্যান্ডেলে ঢোকার ধকও নেই, তারা এইসব নির্জনতায় knowing thyself করতে থাকে, এদের সঙ্গে এই সময়ে পাড়ার পাগল-পাগলিদের আচরণগত মিল পাওয়া যায় যদিও পোষাকের ফারাক সহস্র যোজন। সুতরাং এইসব রাস্তাকে আমি আপনিও বিশেষ পাত্তা দিই না, মাছের কাঁটার মতো সযত্নে অতিক্রম করে যাই – যদি উত্তর কলকাতার দিকের এই ফোঁকরগুলোতে ঢুকে পড়ি, সেখানকার নির্জনতা আবার অন্যরকম, জীবিকার সন্ধানে ছায়ামূর্তি আর দেহাত থেকে আসা কূর্ম্মাবতারের কাছে পুজোটুজোর সেরকম মানে নেই হয়তো। ফলে দুটো পুজোর মাঝখান বলে আপনি যেটাকে দেখবেন সেটা বছরের বাকি ৩৬০ দিন ঐরূপেই থাকে, পার্থক্যটা হলো সম্ভবতঃ ঐসব গলিপথে সেইদিনগুলোয় এই রাতদুপুরে আপনি হাঁটেন না। শুধু আজকের দিনটায় এক প্যান্ডেলে ফসিলস আর আরেক প্যান্ডেল থেকে স্বর্ণযুগের গান এই মাঝখানের খাঁজটায় এসে সাইকোডেলিকালি মিলে যাচ্ছে, তাই আমার আপনার ও হঠাৎ প্রতিমা ও জ্যান্ত দুর্গা দ্যাখার বাসনাটা হারিয়ে যেতে বসছে, নির্জনতাটা চেপে বসছে মাথার ভেতর, নেশার মতন আর এই ঠাকুর দ্যাখার দল থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে গঙ্গার পারের দিকে হাঁটা লাগাতে ইচ্ছে করছে।

যদিও আপনার সামনে উৎসবময়ী কলকাতা এই মুহূর্তে বাস্তবতার আদল নিয়ে নিয়েছে – এই পুজোর মাঝখানের নির্জনতায় যে বাকি বছরটা কাটাতেই হবে, সেই ভেবে স্বস্তি বোধ করছেন না?